কেন লিখেন ? কাদের জন্য লিখেন ? লিখে কি লাভ ?

অদ্ভুত কিছু প্রশ্ন। উত্তর দেয়াটা খুব কঠিন, আবার হয়তো সহজও। নোবেলজয়ী তুর্কী সাহিত্যিক ওরহান পামুক এই প্রশ্নগুলোর পেছনের কারণটা খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন।

তার জবানীতে, “সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে, আমি যখন প্রথম ঔপন্যাসিক হবার সিদ্ধান্ত নিই তখন এই প্রশ্নের মধ্যে অবজ্ঞা ও উন্নাসিকতা ধরা পড়তো। একটা গরিব অ-পাশ্চাত্য দেশ, যে আধুনিক হবার জন্য সংগ্রাম করছে তার জন্য শিল্প সাহিত্যের চর্চা হচ্ছে এমন বিলাসিতা যাকে প্রশ্ৰয় দেয়ার সামর্থ্য দেশটার নাই। এর মধ্যে আরেকটা ইঙ্গিতও ছিল, তোমার মতো একজন শিক্ষিত ও রুচিশীল মানুষ তার দেশকে আরও বেশি ভালো ভাবে সেবা করতে সক্ষম হবে যদি সে ডাক্তার হয়ে মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করে কিংবা প্রকৌশলী হয়ে সেতু নির্মাণ করে।”

সত্তরের দশকের অনুন্নত তুরস্ক আর আজকের উন্নয়নশীল বাংলাদেশের মধ্যে অন্তত লেখালেখির দিক দিয়ে খুব একটা তফাত নেই। আমাদের লিখিয়েরা এখন নানারকম উদ্দেশ্য নিয়ে লেখালেখি করেন, আর সিটিজেন জার্নালিজমের এই যুগে ফেসবুক আর নানারকম ব্লগের দৌরাত্নে লেখা প্রকাশ নিয়েও কোন সমস্যা নেই। হাজারো লাইক-কমেন্ট-শেয়ার আর সেলিব্রেটি হবার অপ্রতিরোধ্য মোহের পাশাপাশি এই লেখালেখির দৌলতে কেউ জাতীয় পুরস্কার আর রাষ্ট্রীয় অনুগ্রহ খোঁজেন, কেউ উন্নত দেশে অ্যাসাইলাম খোঁজেন আর নিতান্তই দুর্ভাগা কেউ কেউ নাজিমুদ্দিন রোডে চৌদ্দশিকের ভেতর ঢোকেন।

আর কেউ কেউ নেহাৎই লেখার জন্য লিখেন। একদিন দুইদিন না লিখলে হাত নিশপিশ করে, এর সাথে যদি অ্যাপ্রিসিয়েশন পাবার বাসনাটুকু যোগ হয়, তাহলে কথাই নেই। অনেকের জন্য এটিই হয়তো লেখার মূল অনুপ্রেরণা। রাজনীতি থেকে পল্লীগীতি, দেশের প্রতিটা ইস্যুতে বুঝি বা না বুঝি আমার মূল্যবান মতামত বিশ্বকে জানান দেওয়া চাই। অ্যাটেনশন সিকার, লাইকখোর বা লাইকহোর (?!), এই বিরল সম্মানগুলো তো ফেসবুকার ‘সেলিব্রেটি’ আর ‘বোলোগার’দের জন্যই, অনলাইনে বসবাসকারী প্রানীকূলের মধ্যে তারাই সবচেয়ে ‘মেধাবী’ কি না ! তাদের খুব বেশি দোষও নেই অবশ্য, এ যে মনুষ্যচরিত !

tumblr_n2ekvh132c1rzik3go1_500

তাই হয়তো আমরা লিখি, অবশ্য বেশিরভাগই লিখি না, কখনও সেই অপচেষ্টা করেও দেখি না।

অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ, আমরা পড়ি না। আর না পড়ার কারণ খুবই স্বাভাবিক, আমরা চিন্তা করতে চাই না। আমরা বলতে এখানে খানিকটা অতি-সরলীকরণই করে আমি বোঝাচ্ছি আমাদের অনলাইন কম্যুনিটির একটা বড় অংশ, ‘চিন্তাশীল’ এবং ‘বুদ্ধিজীবি’ শ্রেণীকে না। এই না-পড়া না-লেখা না-জানার মাধ্যমে এমন একটা প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে যাদেরকে খুব সহজেই ডিসট্র্যাক্ট করা যায়, চিন্তাধারার গতিপথকে সহজেই ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়া যায়। দু’চার জন ইয়াং ছেলে একসাথে হয়ে ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যান নিয়ে আলাপ করে এবং ফোনের দিকে ঝুকে থেকে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিচ্ছে, এই জিনিস মেনে নেয়া খুব কঠিন।

এই না পড়া, না লেখা না জানা বাংলাদেশের অনলাইনে যখন স্রেফ চাকরী খোজা আর পর্ণ দেখাই ছিল আমজনতার মুখ্য কাজ, তখন ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে আসলো সামহয়্যারইন ব্লগ, আমাদের আদরের ‘সামু’ ব্লগ। বছর দুইয়ের মধ্যেই চলে আসলো আরও কয়েকটি ব্লগ।আমাদের জাতিগত স্বভাবের কারণে রাজনীতির ভেতর ঢুকতে থাকলো পলিটিক্স, আদর্শিক এবং রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিভেদের সূচনা হলো বাংলা ব্লগোস্ফিয়ারে। ভেতরে ভেতরে ফুটতে থাকা এই আপাতনিরীহ সাইবার ইন্টেলেকচুয়ালদের জগতে রেষারেষি বাড়তে বাড়তে বিস্ফোরণ ঘটলো ২০১৩ সালে। স্রেফ ব্লগার এবং ব্লগিং এর মাধ্যমেই শুরু হলো রক্তপাত সংঘাতের সংস্কৃতি, শাহবাগ-মতিঝিল-আস্তিক-নাস্তিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার বলি হলে দুই শিবিরের মানুষজনেরাই, একই সঙ্গে তা কবরস্থ করে গেল বাংলা ব্লগোস্ফিয়ারকে। এর জায়গা নিয়েছে ফেসবুক, লম্বাচওড়া স্ট্যাটাসেই এখন চলে যুদ্ধ, কারণ ইনস্ট্যান্ট অ্যাপ্রিসিয়েশন পাওয়া যায় এতে। এরপর একদিন-দু’দিন যেতেই কালের গর্ভে হারিয়ে যায় সেই স্ট্যাটাসের ঝাঁঝ, বাঙ্গালীর বিষের অনলাইন সংস্করণ হিসেবে এর চেয়ে বেশি কিছু স্ট্যাটাসদাতা নিজেও প্রত্যাশা করেন না।

আমাদের ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা, ভূ-রাজনীতি আর তথাকথিত সন্ত্রাসবাদের জ্বালানী পুড়িয়ে এর রেশ আমরা ২০১৬ সালে এসেও টানছি, কবে শেষ হবে তার কোন চিহ্ন আপাতত দেখা যাচ্ছে না।

এই বিষয়টির সাথে একই সঙ্গে সামনে এসে দাঁড়ায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বনাম ধর্ম বা রাষ্ট্র বা ব্যক্তিস্বত্বার সেই চিরন্তন বিবাদ। ব্যক্তিস্বাধীনতার কোন সীমারেখা থাকবে কি না, থাকলে কে তা বাঁধবে এবং কতটুকু বাঁধবে, এই নিয়ে সারা পৃথিবীতেই বাঘা বাঘা আইনবিদেরা হিমশিম খাচ্ছেন। বিশেষ করে যেসব জায়গায় রাষ্ট্রযন্ত্র স্বয়ং নিপীড়নের পথ অবলম্বন করে, সেখানে আইন আর মানবাধিকারের পেরিমিটারে অনেক কিছুরই জায়গা হয় না; এবং পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই এখন এই চর্চা চালু হয়েছে।

মার্কিন গবেষক নাথান লীনের একটা দুর্দান্ত বই আছে, দ্য ইসলামোফোবিয়া ইন্ডাস্ট্রি নামে যেটি ২০১১ সালে প্রকাশিত হয়। এখানে তিনি দেখাতে চেয়েছেন কিভাবে ৯/১১ এর পর মার্কিন রাজনীতি-অর্থনীতি-ব্যবসায়ী-মিডিয়া অর্থাৎ রুলিং এলিটদের মধ্যে ইসলাম বিষয়ে ঘৃণার চাষাবাদ শুরু হয়, যার অবশ্যম্ভাবী ফল ছিল ওয়ার অন টেরর এবং আজকের ডোনাল্ড ট্রাম্পদের মত মানুষের হিংস্রতম বিদ্বেষ। এই এলিটদের চক্রকে তিনি দেখিয়েছেনএকটি ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে, যেটি তার নিজের লাভের জন্যই ঘৃণা এবং অসহিষ্ণুতার গাছ লাগায়, যত্ন করে, তার থেকে বহুগুণ বেশি ফল তুলে নেয়।

তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে আজকের বাংলাদেশেও ইদানিং এইরকম একটা সেলফ ডেসট্রাক্টিভ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠছে। আমাদের বুদ্ধিজীবি, তারুণ্য, রুলিং এলিট এবং রুলিংপ্রত্যাশী এলিট, সবার চিন্তার স্পটলাইট মহান মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ঘুরছে, এখনও। এক দল এটাকে সবকিছুর ওপরে স্থান দিচ্ছেন, আরেক দল প্রাণপণে তা অস্বীকার করে যাচ্ছেন। আগামী ইলেকশনের কথা না ভেবে আগামী জেনারেশনের জন্য কাজ করবার মত মানুষ এদেশে আপাতত দেখা যাচ্ছে না, তাই এমব্যাসীগুলোতে ভিড়, বৈধ-অবৈধ পথে আমরা যেকোন মূল্যে ‘বাইরে’ চলে যেতে চাই। সাগর পাড়ি দিয়ে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও দেশ ছাড়ছে মানুষ। তারা কি ডুবন্ত জাহাজের বুদ্ধিমান ইদুর, না বোকা ভীরু কাপুরুষ? অনাগত সময়ের জন্য প্রশ্নটা তোলা থাক।

খুব সম্প্রতি কিছু ঘটনাতেই আমাদের রাজনৈতিক সামাজিক অপরিপক্কতার পরিচয় পাওয়া যায়। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের যে জিগির উঠলো, এর মধ্যেই তার চিরশত্রু ভারতের ‘রক্তপিপাসু’ প্রধাণমন্ত্রী পাকিস্তানে গিয়ে প্রধাণমন্ত্রীর মা’কে প্রণাম করে আসলেন। মোটাবুদ্ধির পাঠান আর চিকনবুদ্ধি বাঙ্গালের ঝগড়ায় জয় হলো চানক্যের। প্যারিসে পরিবেশ সম্মেলন হলো, যদিও এইধরণের বিশ্বমানের সম্মেলনগুলো আইওয়াশ ছাড়া কিছুই নয়, তবুও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবার সম্ভাবনাময় কয়েকটি দেশের মধ্যে আমরা আমাদের কথাগুলো সেখানে বলতে পারলাম না। না সরকার, না বিরোধী দল না সুশীল সমাজ, কারো এইসব বিষয়ে কোন আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। কারণ, ফরওয়ার্ড থিংকিং বলে কোন শব্দ আমাদের ডিকশনারীতে আমরা পাইনা। ১৯৭১ এ কি হয়েছিল বা কি হয়নি, তা নিয়ে রক্তপাত পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ২০৫১ সালে দেশে কি হবে বা হওয়া উচিত, এই নিয়ে দৃষ্টিপাত করবার ইচ্ছা কারো নেই। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের নাগরিকদের যেই তিনটি মৌল বিষয়ের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়েছিল, সেই সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার এই দেশের জন্য কোনদিন নিশ্চিত করতে পারবো কি না, তার কোন চিহ্ন আপাতত দেখা যাচ্ছে না। কারণ খুব পরিস্কার, দেশে এখন শুরু হয়েছে ঘৃণার চাষাবাদ, একে অপরের প্রতি এতো বিদ্বেষ জাতি হিসেবে আমাদের মধ্যে কখনো ছিল কি না জানি না।

Enemies

সুতরাং, শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে, হোক। দেশ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে, হোক। প্রাকৃতিক সম্পদ বন-জঙ্গল-সুন্দরবন সাফা হয়ে যাচ্ছে, যাক। কোটি মানুষের ঘনবসতিপূর্ণ ছোট দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে, অসুবিধা কোথায়? নিরীহ সুশীল আমরা খেয়েপরে বেঁচে তো আছি, হাসি আড্ডা গানে চলতে থাকুক জীবন। এতো জেনে কি হবে? জানিয়েই বা কি হবে?

তাই, আমরা কিছু লিখবো না। কি হবে লিখে ?

প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক আহমদ ছফাকে লেখালেখি নিয়ে যে বয়ানটা দিয়েছিলেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ।

‘লেখার ব্যাপারটা অইল পুকুরে ঢিল ছোড়ার মত ব্যাপার। যত বড় ঢিল যত জোরে ছুড়বেন, পাঠকের মনে তরঙ্গটাও তত জোরে উঠব এবং অধিকক্ষণ থাকবো।’

সব অনুভূতি-স্বপ্ন হারিয়ে জোম্বি হয়ে যাবার পথে রয়েছি আমরা, সামনে এগুতে গেলেই বারবার পিছু টেনে ধরে ইতিহাস, সমাজ, বুদ্ধিজীবি আর রাজনীতিবিদেরা। কলম ঠুকে বা কি-বোর্ড টিপে এই শক্ত ঢিল ছোড়বার শক্তিটুকু আমাদের স্মার্টফোনে ‘ঘাড়ভাঙ্গা জেনারেশনের’ আছে কি? অথবা সেই তরঙ্গ অনুভবের ক্ষমতা?

তাই লিখুন, যা ইচ্ছা তাই। এসব লিখা প্রকাশে কোন আশংকা থাকলে স্রেফ নিজের জন্য লিখুন। ফেসবুকের সস্তা লাইক-জনপ্রিয়তার জন্য নয়, ব্লগে তুলে রাখুন বা ডায়েরি লিখুন। খুবই কঠিন এবং হতাশামূলক কাজ, সন্দেহ নেই। তবে এই পোড়া দেশে আমরা যারা নিরীহ সুশীল, অনাগত প্রজন্মের জন্য আর কিছু দিতে পারি বা না পারি, অন্তত আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর অভিজ্ঞতাটুকু দিয়ে যেতে দোষ কি?

যে ভুল আমরা করে চলেছি, তারা হয়তো সেই ভুল করবে না।

 


“কেন লিখি না ? কেন আপনি লিখেন না ?” এ একটি মন্তব্য

  1. […] আর উৎসাহ সবই উনারা। মাহদী ভাইয়ের কেন লিখিনা? কেন আপনি লিখেন না? শিরোনামের লেখাটা এই ব্যাপারে […]

    Like

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.